১১:৩৪ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ২৪ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জাবিতে হল সংসদ নেত্রীসহ ৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ, পরে প্রত্যাহার

  • Sangbad365 Admin
  • সময়ঃ ১২:০২:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর ২০২৫
  • ১৬০১০ Time View

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) চারুকলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী প্রান্ত রায়কে র‍্যাগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে একই বিভাগের সিনিয়র পাঁচ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে।

র‍্যাগিংয়ের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ১৬ জন শিক্ষার্থীর স্বাক্ষর সম্বলিত একটি অভিযোগপত্র বিভাগের সভাপতি বরাবর জমা দেওয়া হয়। বিভাগের সভাপতি অভিযোগপত্রটি প্রক্টর অফিসে ফরওয়ার্ড করেন। পরে বিভাগের দুই শিক্ষক বিষয়টি মীমাংসার আশ্বাস দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বলায় ভুক্তভোগীরা তা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন।

অভিযুক্ত ওই পাঁচ শিক্ষার্থী হলেন- চারুকলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের (৪৯ ব্যাচ) ঐশী সরকার অথি, তৃতীয় বর্ষের (৫০ ব্যাচ) প্রমা রাহা, দ্বিতীয় বর্ষের (৫১ ব্যাচ) নোমান, আরিয়ান ও সেজান। এদের মধ্যে অথি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলতুন্নেছা হল সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) এবং প্রমা রাহা সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)।

ঘটনা সূত্রপাত হয়, গত ২৭ আগস্ট চারুকলা বিভাগের ৫৩ আবর্তনের দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে অনুষদের ডিন অফিসের এক কর্মচারীর কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে। ব্যবহারিক পরীক্ষা চলার সময় দুই ছাত্রী বিভাগের বারান্দায় উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকলে তমা নামের ওই কর্মচারী এসে তাদের ধমক দিয়ে কথা শুনিয়ে চলে যান। ওই কর্মচারীকে আগে থেকে না চেনায় এবং তার এমন ব্যবহারে খারাপ লাগায় ওই দুই ছাত্রী বিষয়টি শিক্ষকদের জানাতে চান। তবে উপস্থিত অন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের জানাতে নিরুৎসাহিত করেন। পরে ওই কর্মচারী সুজ্জল নামের আর এক কর্মচারীসহ এসে ওই দুই ছাত্রীর কাছে পূর্বের ঘটনার জন্য ক্ষমা চান এবং সেখানেই ঘটনার মীমাংসা হয়ে যায়।

তবে ওই দুই কর্মচারী পরবর্তীতে এই ঘটনা বিভাগের সিনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীদের জানালে তারা প্রথম বর্ষের ওই শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষুব্ধ হন।

ওইদিনই দুপুর ২টার দিকে চারুকলা বিভাগের প্রথম বর্ষের (৫৩ ব্যাচ) শিক্ষার্থীদের বিভাগের আউটডোরে পার্সপেক্টিভ পরীক্ষা চলাকালে তাদেরকে ৫ মিনিটের কথা বলে বিভাগের দ্বিতীয় তলায় গ্যালারি কক্ষে ডেকে নিয়ে ৪৫ মিনিট ধরে তাদের সঙ্গে কথা বলেন বিভাগের ৪৯, ৫০ ও ৫১ ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ সময় প্রথম বর্ষের প্রায় ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। তবে অসুস্থ থাকায় সেখানে উপস্থিত হতে দেরি করায় অভিযুক্তদের দ্বারা র‍্যাগিং, হুমকি ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী প্রান্ত রায়।

এ ঘটনার পরবর্তী ১১ দিন ধরে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মীমাংসার চেষ্টা করলেও তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় গত ৮ সেপ্টেম্বর বিভাগের সভাপতি বরাবর ঘটনাস্থলে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি লিখিত অভিযোগ প্রদান করেন। বিভাগের সভাপতি পরদিন (৯ সেপ্টেম্বর) অভিযোগপত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর ফরোয়ার্ড করেন।

অভিযোগপত্রে ভুক্তভোগী প্রান্ত রায় বলেন, “৫১তম আবর্তনের নোমান ভাই ও আরিয়ান ভাই পরীক্ষার মধ্যে এসে আমাকে ও আমার সহপাঠীদের পরীক্ষা ছেড়ে জোরপূর্বক জয়নুল গ্যালারিতে যেতে বাধ্য করেন। সেখানে গেলে ৪৯তম আবর্তনের ঐশি সরকার (অথি) আপু ও ৫০তম আবর্তনের প্রমা রাহা আপু প্রকাশ্যে আমাকে অপমান, ধমক ও হুমকি প্রদান করেন।”

তিনি বলেন, “এ সময় আমাদের বলা হয়, ‘সিনিয়রদের কথা না শুনলে বিভাগে টিকে থাকা সম্ভব না। যা বিচার দিবি দে, চেয়ারম্যানের কাছেও দে, সব বিচার তো আমাদের কাছেই আসবে, আমাদেরই করতে হবে। সেখানে ৪৯ ব্যাচের অথি আমার চেহারা নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘ওর মুখটাই এমন, ও এমনেই থাকে, জন্ম থেকে এমন, এমনই জন্মাইছে।’ সিজান (৫১ ব্যাচ) হুমকি দিয়ে বলেন, ‘লাথি মেরে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের করে দেব।’ এছাড়া নোমান চিৎকার করে আমাদের সবাইকে সেই কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন।” এতে পরীক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং প্রান্ত সুস্থভাবে পরীক্ষা দিতে পারেননি বলে জানান।

অভিযোগপত্রে শুধু কয়েকটা লাইন উল্লেখ থাকলেও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে আরো বাজে ভাষায় হেনস্তা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী।

পরে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার খবর জানাজানি হলে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মীমাংসার চেষ্টা করেন।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর এরই পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি হওয়ার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বিভাগের দুই শিক্ষকের সহায়তায় মধ্যস্ততা করে অভিযোগপত্র প্রত্যাহারের চেষ্টা করেন অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা।

বিভাগের ওই দুই শিক্ষক হলেন অধ্যাপক এম এম ময়েজউদ্দিন ও সহযোগী অধ্যাপক ধীমান সরকার।

এই দুই শিক্ষক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিযোগপত্র প্রত্যাহারের জন্য বোঝানোর চেষ্টা করলে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানান, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের লিখিতভাবে বলতে হবে, তারা এই ঘটনায় দুঃখিত এবং সামনে আর এমন ঘটনা ঘটবে না।

এ সময় অধ্যাপক ময়েজউদ্দিন বিভাগ বরাবর অভিযুক্তদের লিখিত কপির ভিত্তিতে অভিযোগপত্র প্রত্যাহার করতে বলেন। তিনি আশ্বাস দেন, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটবে না।

তবে অভিযুক্তদের লিখিত কপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এ রকম ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, সেজন্য আমরা সতর্ক থাকবো।’

সেখানে ৪৯-৫১ ব্যাচের অল্প কয়েকজন সিনিয়র র‍্যাগিংয়ে যুক্ত থাকলেও লিখিত কপিতে ‘৪৯-৫২ তম আবর্তনের সকল শিক্ষার্থীর পক্ষে’ উল্লেখ থাকায় আপত্তি জানান ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। তার দাবি, এটি সংশোধন করে লিখতে হবে, ‘ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটবে না’ এবং এর স্বপক্ষে শুধু র‍্যাগিংয়ে যুক্ত শিক্ষার্থীদের নাম সংযুক্ত থাকতে হবে।

এর পরদিন ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে পুজার ছুটি শুরু হওয়ায় সহযোগী অধ্যাপক ধীমান সরকার ছুটির পর অভিযুক্তদের লিখিত বক্তব্য সংশোধন করে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সেদিনই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। এ আশ্বাসে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা প্রক্টর অফিসে অভিযোগ প্রত্যাহারের আবেদন জমা দিতে যান।

বিভাগের সভাপতি সেদিন ক্যাম্পাসের বাহিরে থাকায় আবেদনপত্রে অধ্যাপক এমএম ময়েজউদ্দিন স্বাক্ষর করে দেন। সেই আবেদন জমা দিতে গেলে প্রক্টর জানান, ইতোপূর্বে এই ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন হয়ে গেছে। এছাড়া বিভাগের সভাপতির স্বাক্ষর না থাকায় এই আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়।

তখন তারা ফিরে এসে আরেকটি অভিযোগপত্র লিখে সেখানে প্রান্ত স্বাক্ষর করে পূজার ছুটিতে বাড়ি চলে যান। তার সহপাঠীরা সেদিনই (২৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধার পর বিভাগের সভাপতির স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। এরপর রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ভুক্তভোগী প্রান্তের অনুপস্থিতিতেই বিভাগের সভাপতির স্বাক্ষর সম্বলিত আবেদনপত্রটি পুনরায় প্রক্টর অফিসে জমা দেন।

তবে আবেদনপত্রে স্বাক্ষর ও মধ্যস্থতার কথা অস্বীকার করে অধ্যাপক এম এম ময়েজউদ্দিন বলেন, “এর সত্যতা নেই। আমি স্বাক্ষর করিনি। বিভাগের সভাপতির স্বাক্ষর না থাকায় আবেদনটি  প্রক্টর অফিস থেকে রিফিউস করেছে। আবেদনপত্রে যদি আমার স্বাক্ষরের প্রমাণ দেখাতে পারো, তখন আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব।”

২৫ সেপ্টেম্বর আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় প্রক্টর অফিসে উপস্থিত একজন সহকারী প্রক্টর সেখানে অধ্যাপক ময়েজউদ্দিনের স্বাক্ষরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়া চারুকলা বিভাগের ৫৩ ব্যাচের সিআর নুরনাহার আক্তার নুনী আবেদনপত্রে অধ্যাপক ময়েজউদ্দিনের স্বাক্ষরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “সেদিন বিভাগের সভাপতিসহ অন্যান্য শিক্ষক না থাকায় ময়েজউদ্দিন স্যারের কাছ থেকে অনুরোধ করে তার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।” নুরনাহার নিজেও প্রক্টর অফিসে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন।

অভিযোগপত্র প্রত্যাহারে মধ্যস্থতা করা আরেক শিক্ষক চারুকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ধীমান সরকার বলেন, “বিভাগে যেহেতু এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, আমরা উভয় পক্ষের সঙ্গেই কথা বলেছি। সেখানে সিনিয়রদের দোষ তো অবশ্যই কিছু ছিল। তাই তাদের বকাঝকাও দিয়েছি যে, কেন তারা এ রকম কথাবার্তা বলেছে, তাও আবার পরীক্ষার মাঝখানে।”

তিনি আরো বলেন, “প্রান্ত যেহেতু ভুক্তভোগী, তার সঙ্গেও খোলাখুলি কথা হয়েছে। তাকে বুঝিয়েছি, সিনিয়ররা অনুতপ্ত, তারা চিঠিও দিয়েছে। চাইলে তুমি অভিযোগ প্রত্যাহার করতে পারো। অভিযোগ প্রত্যাহারের যে আইনি প্রক্রিয়া আছে, লিখিতভাবে আবেদন করার, সেটিও তাকে জানানো হয়েছে। তবে তাকে এটাও বলা হয়েছিল, সে যদি প্রক্টর অফিসেই এর সমাধান করতে চায়, তাহলে আবেদনপত্র দিতে হবে না। তার জন্য দুটো অপশনই খোলা ছিল।”

ভুক্তভোগী প্রান্ত বলেন, “আমাদের পরীক্ষা চলার সময় ৫ মিনিটের কথা বলে ৪৫ মিনিট সময় নষ্ট করা হয়েছে। বিভাগের সিনিয়রদের সঙ্গে আমার আগেও কোনো শত্রুতা ছিল না, এখনো নেই। তবুও সেদিন বিনাকারণে আমার সঙ্গে র‍্যাগিং, বডিশেমিং, হুমকি প্রদানের ঘটনা মানসিকভাবে আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।”

এ বিষয়ে অভিযুক্ত ঐশী সরকার বলেন, “অভিযোগপত্রে আমার কথাগুলো ঘুরিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঘটনাটি র‍্যাগিং, বুলিং বা বডিশেমিং ছিল না। সেদিন সেখানে ৪৯-৫১ ব্যাচের ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু অভিযোগে কেবল আমাদের কয়েকজনের নাম এসেছে।”

অভিযুক্ত প্রমা রাহা বলেন, “আমরা বিভাগ বরাবর সবাই মিলে দুঃখ প্রকাশ করেছি। প্রান্তের অভিযোগে আমার নামে যে কথা বলা হয়েছে, সেটা নিয়ে পরবর্তীতে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত কমিটি দেখছে।”

চারুকলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, “ঘটনাটি বিভাগের ভেতরে সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী প্রক্টর বরাবর আবেদন করে। পরে আবার তারা নিজেরাই বিভাগীয়ভাবে বিষয়টি মীমাংসার আবেদন করেছে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, “এই বিষয়ে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

গত ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া র‍্যাগিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রণীত শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ২০১৮ এর ৫(ঘ) ও ৫(ঙ) ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, ক্যাম্পাস, বিভাগ বা হলের ভেতরে টিজ, র‍্যাগিং বা নির্যাতনমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি সাময়িক বহিষ্কার থেকে স্থায়ী বহিষ্কার পর্যন্ত হতে পারে।

ট্যাগঃ

জাবিতে হল সংসদ নেত্রীসহ ৫ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে র‍্যাগিংয়ের অভিযোগ, পরে প্রত্যাহার

সময়ঃ ১২:০২:০১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর ২০২৫

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) চারুকলা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী প্রান্ত রায়কে র‍্যাগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে একই বিভাগের সিনিয়র পাঁচ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে।

র‍্যাগিংয়ের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ১৬ জন শিক্ষার্থীর স্বাক্ষর সম্বলিত একটি অভিযোগপত্র বিভাগের সভাপতি বরাবর জমা দেওয়া হয়। বিভাগের সভাপতি অভিযোগপত্রটি প্রক্টর অফিসে ফরওয়ার্ড করেন। পরে বিভাগের দুই শিক্ষক বিষয়টি মীমাংসার আশ্বাস দিয়ে অভিযোগ প্রত্যাহার করতে বলায় ভুক্তভোগীরা তা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন।

অভিযুক্ত ওই পাঁচ শিক্ষার্থী হলেন- চারুকলা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের (৪৯ ব্যাচ) ঐশী সরকার অথি, তৃতীয় বর্ষের (৫০ ব্যাচ) প্রমা রাহা, দ্বিতীয় বর্ষের (৫১ ব্যাচ) নোমান, আরিয়ান ও সেজান। এদের মধ্যে অথি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলতুন্নেছা হল সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) এবং প্রমা রাহা সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস)।

ঘটনা সূত্রপাত হয়, গত ২৭ আগস্ট চারুকলা বিভাগের ৫৩ আবর্তনের দুই শিক্ষার্থীর সঙ্গে অনুষদের ডিন অফিসের এক কর্মচারীর কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে। ব্যবহারিক পরীক্ষা চলার সময় দুই ছাত্রী বিভাগের বারান্দায় উচ্চস্বরে কথা বলতে থাকলে তমা নামের ওই কর্মচারী এসে তাদের ধমক দিয়ে কথা শুনিয়ে চলে যান। ওই কর্মচারীকে আগে থেকে না চেনায় এবং তার এমন ব্যবহারে খারাপ লাগায় ওই দুই ছাত্রী বিষয়টি শিক্ষকদের জানাতে চান। তবে উপস্থিত অন্য শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের জানাতে নিরুৎসাহিত করেন। পরে ওই কর্মচারী সুজ্জল নামের আর এক কর্মচারীসহ এসে ওই দুই ছাত্রীর কাছে পূর্বের ঘটনার জন্য ক্ষমা চান এবং সেখানেই ঘটনার মীমাংসা হয়ে যায়।

তবে ওই দুই কর্মচারী পরবর্তীতে এই ঘটনা বিভাগের সিনিয়র ব্যাচের শিক্ষার্থীদের জানালে তারা প্রথম বর্ষের ওই শিক্ষার্থীদের ওপর ক্ষুব্ধ হন।

ওইদিনই দুপুর ২টার দিকে চারুকলা বিভাগের প্রথম বর্ষের (৫৩ ব্যাচ) শিক্ষার্থীদের বিভাগের আউটডোরে পার্সপেক্টিভ পরীক্ষা চলাকালে তাদেরকে ৫ মিনিটের কথা বলে বিভাগের দ্বিতীয় তলায় গ্যালারি কক্ষে ডেকে নিয়ে ৪৫ মিনিট ধরে তাদের সঙ্গে কথা বলেন বিভাগের ৪৯, ৫০ ও ৫১ ব্যাচের কয়েকজন শিক্ষার্থী। এ সময় প্রথম বর্ষের প্রায় ৩০-৩৫ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। তবে অসুস্থ থাকায় সেখানে উপস্থিত হতে দেরি করায় অভিযুক্তদের দ্বারা র‍্যাগিং, হুমকি ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী প্রান্ত রায়।

এ ঘটনার পরবর্তী ১১ দিন ধরে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মীমাংসার চেষ্টা করলেও তাদের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় গত ৮ সেপ্টেম্বর বিভাগের সভাপতি বরাবর ঘটনাস্থলে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষর সম্বলিত একটি লিখিত অভিযোগ প্রদান করেন। বিভাগের সভাপতি পরদিন (৯ সেপ্টেম্বর) অভিযোগপত্রটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর বরাবর ফরোয়ার্ড করেন।

অভিযোগপত্রে ভুক্তভোগী প্রান্ত রায় বলেন, “৫১তম আবর্তনের নোমান ভাই ও আরিয়ান ভাই পরীক্ষার মধ্যে এসে আমাকে ও আমার সহপাঠীদের পরীক্ষা ছেড়ে জোরপূর্বক জয়নুল গ্যালারিতে যেতে বাধ্য করেন। সেখানে গেলে ৪৯তম আবর্তনের ঐশি সরকার (অথি) আপু ও ৫০তম আবর্তনের প্রমা রাহা আপু প্রকাশ্যে আমাকে অপমান, ধমক ও হুমকি প্রদান করেন।”

তিনি বলেন, “এ সময় আমাদের বলা হয়, ‘সিনিয়রদের কথা না শুনলে বিভাগে টিকে থাকা সম্ভব না। যা বিচার দিবি দে, চেয়ারম্যানের কাছেও দে, সব বিচার তো আমাদের কাছেই আসবে, আমাদেরই করতে হবে। সেখানে ৪৯ ব্যাচের অথি আমার চেহারা নিয়ে ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘ওর মুখটাই এমন, ও এমনেই থাকে, জন্ম থেকে এমন, এমনই জন্মাইছে।’ সিজান (৫১ ব্যাচ) হুমকি দিয়ে বলেন, ‘লাথি মেরে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের করে দেব।’ এছাড়া নোমান চিৎকার করে আমাদের সবাইকে সেই কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন।” এতে পরীক্ষার পরিবেশ বিঘ্নিত হয় এবং প্রান্ত সুস্থভাবে পরীক্ষা দিতে পারেননি বলে জানান।

অভিযোগপত্রে শুধু কয়েকটা লাইন উল্লেখ থাকলেও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে আরো বাজে ভাষায় হেনস্তা করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বিভাগের একাধিক শিক্ষার্থী।

পরে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার খবর জানাজানি হলে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে মীমাংসার চেষ্টা করেন।

গত ২৫ সেপ্টেম্বর এরই পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি হওয়ার বিষয়টি আঁচ করতে পেরে বিভাগের দুই শিক্ষকের সহায়তায় মধ্যস্ততা করে অভিযোগপত্র প্রত্যাহারের চেষ্টা করেন অভিযুক্ত শিক্ষার্থীরা।

বিভাগের ওই দুই শিক্ষক হলেন অধ্যাপক এম এম ময়েজউদ্দিন ও সহযোগী অধ্যাপক ধীমান সরকার।

এই দুই শিক্ষক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের অভিযোগপত্র প্রত্যাহারের জন্য বোঝানোর চেষ্টা করলে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা জানান, অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের লিখিতভাবে বলতে হবে, তারা এই ঘটনায় দুঃখিত এবং সামনে আর এমন ঘটনা ঘটবে না।

এ সময় অধ্যাপক ময়েজউদ্দিন বিভাগ বরাবর অভিযুক্তদের লিখিত কপির ভিত্তিতে অভিযোগপত্র প্রত্যাহার করতে বলেন। তিনি আশ্বাস দেন, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটবে না।

তবে অভিযুক্তদের লিখিত কপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এ রকম ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, সেজন্য আমরা সতর্ক থাকবো।’

সেখানে ৪৯-৫১ ব্যাচের অল্প কয়েকজন সিনিয়র র‍্যাগিংয়ে যুক্ত থাকলেও লিখিত কপিতে ‘৪৯-৫২ তম আবর্তনের সকল শিক্ষার্থীর পক্ষে’ উল্লেখ থাকায় আপত্তি জানান ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী। তার দাবি, এটি সংশোধন করে লিখতে হবে, ‘ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটবে না’ এবং এর স্বপক্ষে শুধু র‍্যাগিংয়ে যুক্ত শিক্ষার্থীদের নাম সংযুক্ত থাকতে হবে।

এর পরদিন ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে পুজার ছুটি শুরু হওয়ায় সহযোগী অধ্যাপক ধীমান সরকার ছুটির পর অভিযুক্তদের লিখিত বক্তব্য সংশোধন করে নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে সেদিনই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিতে বলেন। এ আশ্বাসে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা প্রক্টর অফিসে অভিযোগ প্রত্যাহারের আবেদন জমা দিতে যান।

বিভাগের সভাপতি সেদিন ক্যাম্পাসের বাহিরে থাকায় আবেদনপত্রে অধ্যাপক এমএম ময়েজউদ্দিন স্বাক্ষর করে দেন। সেই আবেদন জমা দিতে গেলে প্রক্টর জানান, ইতোপূর্বে এই ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন হয়ে গেছে। এছাড়া বিভাগের সভাপতির স্বাক্ষর না থাকায় এই আবেদন গ্রহণযোগ্য নয়।

তখন তারা ফিরে এসে আরেকটি অভিযোগপত্র লিখে সেখানে প্রান্ত স্বাক্ষর করে পূজার ছুটিতে বাড়ি চলে যান। তার সহপাঠীরা সেদিনই (২৫ সেপ্টেম্বর) সন্ধার পর বিভাগের সভাপতির স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। এরপর রবিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) ভুক্তভোগী প্রান্তের অনুপস্থিতিতেই বিভাগের সভাপতির স্বাক্ষর সম্বলিত আবেদনপত্রটি পুনরায় প্রক্টর অফিসে জমা দেন।

তবে আবেদনপত্রে স্বাক্ষর ও মধ্যস্থতার কথা অস্বীকার করে অধ্যাপক এম এম ময়েজউদ্দিন বলেন, “এর সত্যতা নেই। আমি স্বাক্ষর করিনি। বিভাগের সভাপতির স্বাক্ষর না থাকায় আবেদনটি  প্রক্টর অফিস থেকে রিফিউস করেছে। আবেদনপত্রে যদি আমার স্বাক্ষরের প্রমাণ দেখাতে পারো, তখন আমি তোমার সঙ্গে কথা বলব।”

২৫ সেপ্টেম্বর আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় প্রক্টর অফিসে উপস্থিত একজন সহকারী প্রক্টর সেখানে অধ্যাপক ময়েজউদ্দিনের স্বাক্ষরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এছাড়া চারুকলা বিভাগের ৫৩ ব্যাচের সিআর নুরনাহার আক্তার নুনী আবেদনপত্রে অধ্যাপক ময়েজউদ্দিনের স্বাক্ষরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, “সেদিন বিভাগের সভাপতিসহ অন্যান্য শিক্ষক না থাকায় ময়েজউদ্দিন স্যারের কাছ থেকে অনুরোধ করে তার স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে।” নুরনাহার নিজেও প্রক্টর অফিসে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন।

অভিযোগপত্র প্রত্যাহারে মধ্যস্থতা করা আরেক শিক্ষক চারুকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ধীমান সরকার বলেন, “বিভাগে যেহেতু এমন একটা ঘটনা ঘটেছে, আমরা উভয় পক্ষের সঙ্গেই কথা বলেছি। সেখানে সিনিয়রদের দোষ তো অবশ্যই কিছু ছিল। তাই তাদের বকাঝকাও দিয়েছি যে, কেন তারা এ রকম কথাবার্তা বলেছে, তাও আবার পরীক্ষার মাঝখানে।”

তিনি আরো বলেন, “প্রান্ত যেহেতু ভুক্তভোগী, তার সঙ্গেও খোলাখুলি কথা হয়েছে। তাকে বুঝিয়েছি, সিনিয়ররা অনুতপ্ত, তারা চিঠিও দিয়েছে। চাইলে তুমি অভিযোগ প্রত্যাহার করতে পারো। অভিযোগ প্রত্যাহারের যে আইনি প্রক্রিয়া আছে, লিখিতভাবে আবেদন করার, সেটিও তাকে জানানো হয়েছে। তবে তাকে এটাও বলা হয়েছিল, সে যদি প্রক্টর অফিসেই এর সমাধান করতে চায়, তাহলে আবেদনপত্র দিতে হবে না। তার জন্য দুটো অপশনই খোলা ছিল।”

ভুক্তভোগী প্রান্ত বলেন, “আমাদের পরীক্ষা চলার সময় ৫ মিনিটের কথা বলে ৪৫ মিনিট সময় নষ্ট করা হয়েছে। বিভাগের সিনিয়রদের সঙ্গে আমার আগেও কোনো শত্রুতা ছিল না, এখনো নেই। তবুও সেদিন বিনাকারণে আমার সঙ্গে র‍্যাগিং, বডিশেমিং, হুমকি প্রদানের ঘটনা মানসিকভাবে আমাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।”

এ বিষয়ে অভিযুক্ত ঐশী সরকার বলেন, “অভিযোগপত্রে আমার কথাগুলো ঘুরিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। ঘটনাটি র‍্যাগিং, বুলিং বা বডিশেমিং ছিল না। সেদিন সেখানে ৪৯-৫১ ব্যাচের ৫০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু অভিযোগে কেবল আমাদের কয়েকজনের নাম এসেছে।”

অভিযুক্ত প্রমা রাহা বলেন, “আমরা বিভাগ বরাবর সবাই মিলে দুঃখ প্রকাশ করেছি। প্রান্তের অভিযোগে আমার নামে যে কথা বলা হয়েছে, সেটা নিয়ে পরবর্তীতে তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত কমিটি দেখছে।”

চারুকলা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শামীম রেজা বলেন, “ঘটনাটি বিভাগের ভেতরে সমাধান করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী প্রক্টর বরাবর আবেদন করে। পরে আবার তারা নিজেরাই বিভাগীয়ভাবে বিষয়টি মীমাংসার আবেদন করেছে।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম রাশিদুল আলম বলেন, “এই বিষয়ে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

গত ২০ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া র‍্যাগিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রণীত শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ২০১৮ এর ৫(ঘ) ও ৫(ঙ) ধারায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, ক্যাম্পাস, বিভাগ বা হলের ভেতরে টিজ, র‍্যাগিং বা নির্যাতনমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ানো সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী শাস্তি সাময়িক বহিষ্কার থেকে স্থায়ী বহিষ্কার পর্যন্ত হতে পারে।