অনুমিত চিত্রনাট্যই যেন অনুসরণ করল মুম্বাইয়ের ফাইনাল ম্যাচ। ভারতের জার্সি গায়ে দর্শকে ঠাসা গ্যালারি রূপ নিল নীল সমুদ্রে। ২২ গজে আরও একবার ভারতের আধিপত্য, শাসন। যেন শিরোপার পায়চারি অনেক আগের থেকেই।
ব্যাটিংয়ে পর্বত ছুঁই-ছুঁই রান। এরপর স্পিনে ফুল ফোটালেন স্পিনাররা। দক্ষিণ আফ্রিকা লড়াই করল সাধ্যের সবটুকু দিয়ে। ব্যাটে-বলে সহজে হাল ছাড়ল না তারাও। হৃদয় জিতলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাত্তাই পেল না। ভারতের শক্তি-সামর্থ্যের গভীরতার কাছে হার মানতেই হলো প্রোটিয়া নারীদের।
মুম্বাইয়ের নাভি স্টেডিয়ামের নীল সমুদ্রে সব আতশবাজি আজ রাতে ফুটল ভারতের বিশ্বকাপ উদ্যাপনে। প্রথমবার ভারতের নারী ক্রিকেট দল ওয়ানডেতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। ৫২ রানের বিশাল জয় বুঝিয়ে দেয় হারমানপ্রীত কৌর, জেমিমা রদ্রিগেজ, দীপ্তি শর্মা কিংবা শেফালি বার্মা, স্মৃতি মান্ধানা, রিচা ঘোষরা ২২ গজকে কতটা আপন করে নিয়েছেন। শিরোপা জয়ের মঞ্চে ছাড় দেননি একটুও। ২০০৫ ও ২০১৭ বিশ্বকাপে যে ভুলগুলো হয়েছিল…সেগুলো আজ ফুল হয়ে ঝরল।
বৃষ্টি বাঁধায় বিঘ্ন ম্যাচে আগে ব্যাটিংয়ে নেমে ৭ উইকেটে ২৯৮ রানের স্কোর পায় ভারত। ৪৫.৩ ওভারে অলআউট হওয়ার আগে ২৪৬ রান করতে পারে প্রোটিয়া নারীরা। নাডিন ডি ক্লার্ক শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে যখন আউট হলেন, স্টেডিয়ামের প্রায় ষাট হাজার ভারতীয় সমর্থকদের মুখে একটাই স্লোগান, চাক দে ইন্ডিয়া।
ওই জনসমুদ্রের স্লোগান, ‘ভারত মাতা কি জয়’, ‘বন্দে মাতরম’।
এই উৎসব, এই আনন্দ আয়োজনের পরতে পরতে কতো চিত্রনাট্য। কতো উত্থান-পতন। কতো সাফল্য ধরা দেয়া। আবার কতো ব্যর্থতাকে সঙ্গী করা। সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল সোনালী সেই ট্রফি জয়ে। ১৯৮৩ সালে কপিল দেব ভারতকে জিতিয়েছিলেন পুরুষদের প্রথম বিশ্বকাপ শিরোপা। আজ হারমানপ্রীত কৌর ইতিহাসের অক্ষয় কালিতে লিখে নিলেন নিজের নাম।
অযুত-নিযুত ঘামবিন্দু ঝরিয়ে কেনা সেই ট্রফিটা হাতে নিয়ে হারমানপ্রীত উচিঁয়ে ধরলেন সতীর্থদের নিয়ে। আনন্দাশ্রু ভিজে গেল নাভির সবুজ গালিচা। হরেক রকম কাগজের ফেস্টুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের ভিজিয়ে দেয় প্রাপ্তি ডালায়, অর্জনের মালায়।
বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রিগেডের সবচেয়ে ভাগ্যবান ক্রিকেটারই ফাইনালে গড়ে দিলেন ব্যবধান। সপ্তাহখানেক আগেও বিশ্বকাপের ধারেকাছে ছিলেন না শেফালি। মূল স্কোয়াডে তো নয়ই, রিজার্ভ তালিকাতেও ছিল না তার নাম। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে চোট পেয়ে প্রাতিকা রাওয়াল ছিটকে গেলে ভারতের নির্বাচকরা শেফালিকে উড়িয়ে আনেন সুরাট থেকে। হারিয়ানার হয়ে খেলছিলেন ওমেন্স টি-টোয়েন্টি ট্রফিতে।
সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তেমন ভালো করতে পারেননি (১০ রান)। আজ ফাইনালে ৮ চার ২ ছক্কায় করলেন ৭৮ বলে ৮৭ রান। এরপর বল হাতে ২ উইকেট। ব্যাস! ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ২১ বছর বয়সী শেফালি। জীবনে আর কী চাই। এক সপ্তাহ আগেও টিভির পর্দায় যিনি বিশ্বকাপ দেখছিলেন, তিনি ভারতের প্রথম বিশ্বকাপের নায়ক। কল্পনা করা যায়?
ম্যাচে ছোট-বড় অনেক অবদান নীল জার্সিধারীদের। স্মৃতি শুরুতে ৪৫ রান করলেন। শেফালির সঙ্গে তার জুটি ১০৪ রানের। সেমিফাইনালের তারকা জেমি ২৪ রানে থেমে যান। অধিনায়ক হারমানপ্রীত করেন ২০। শেষটা রাঙান দীপ্তি শর্মা ও রিচা ঘোষ। দীপ্তি ৫৮ বলে ৫৮ করেন ৩ চার ও ১ ছক্কায়। রিচা ২৪ বলে ৩ চার ও ২ ছক্কায় ৩৪ রান করে দলের রান তিনশর কাছাকাছি নিয়ে যান। ব্যাটিংয়ে ভালো করার পর দীপ্তি অফস্পিনে বিষ ছড়িয়ে ৫ উইকেট নেন। সঙ্গে শেফালি ২ ও শ্রী চারানি ১ উইকেটের স্বাদ পেলেন। দারুণ ফিল্ডিংয়ে রান আউট দুইটি।
দক্ষিণ আফ্রিকা কেমন জবাব দেবে তা নির্ভর করছিল অধিনায়ক লরা উলভার্টের ব্যাটের উপর। হতাশ করেননি তিনি। যতক্ষণ ক্রিজে ছিলেন ভারতীয় শিবির ছটফট করছিল। ১৫৮ মিনিট মাঠে কাটিয়ে ১১ চার ও ১ ছক্কায় ৯৮ বলে করলেন ১০১ রান। ৪২তম ওভারে দীপ্তি শর্মা যখন তাকে ফেরালেন তখনই ম্যাচের এপিটাফ লিখা হয়ে যায়। বাকিদের কেউ তো চল্লিশের ঘরও পেরোতে পারেননি।
নীল সমুদ্র লরার আউটেই বিশ্বকাপের শিরোপার আঁচ পেয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটায় যখন ১২টা ছুঁই ছুঁই তখনই আসে মাহেন্দ্র ক্ষণ। তেরাশির বিশ্বকাপে মাইকেল হোল্ডিংকে এলবিডব্লিউ করে আমারনাথ নিশ্চিত করেছিলেন শিরোপা। দীপ্তির বলে আজ ডি ক্লার্ক ক্যাচ দেন কাভারে। হারমানপ্রীত খানিকটা দৌড়ে মাথার উপরের ক্যাচ নিলেন অতি সহজে। অলআউট প্রোটিয়ারা। অধিনায়ক ছুটলেন। তার পেছনে গোটা ভারত।
নারীদের ১৩তম বিশ্বকাপ আসরে বিশ্ব পেল নতুন এক চ্যাম্পিয়ন, ভারত।
অবিশ্বাস্য, অসাধারণ, অনবদ্য, অবিস্মরণীয়।
Sangbad365 Admin 














