১১:১৪ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব: ভেটেরিনারি অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবের নেপথ্যে ‘সেতু-রতু-রাঙ্গা চক্র’

  • Sangbad365 Admin
  • সময়ঃ ০৪:০২:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ১৬১৫৩ Time View

পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব: ভেটেরিনারি অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবের নেপথ্যে ‘সেতু-রতু-রাঙ্গা চক্র’

রংপুরের পীরগাছা:

গত মে ২০২৫ থেকে রংপুরের পীরগাছায় ভয়াবহ অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে, মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১০ জনের। আক্রান্ত পশুর সংখ্যা হাজারের বেশি বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। শুরুতে এ বিষয়ে নানা অভিযোগ উঠলেও উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জনের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সাংবাদিকদের সতর্কতা উপেক্ষা

পীরগাছা উপজেলা সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম একাধিকবার ভেটেরিনারি সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি তা উপেক্ষা করেন। এমনকি পার্শ্ববর্তী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আক্রান্ত রোগীদের দেখতে যেতেও ভেটেরিনারি সার্জন অনীহা দেখান। পরিস্থিতি অবনতির দিকে গেলে সাংবাদিকরা সংবাদ প্রকাশ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হন।

অ্যানথ্রাক্স কী?

অ্যানথ্রাক্স একটি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি, যা মূলত গরু, ছাগল, ভেড়া ও ঘোড়ার মতো প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়। ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়ার স্পোর থেকে এ রোগের উৎপত্তি হয়, যা মাটি, প্রাণী বা প্রাণীজ পণ্যের মাধ্যমে মানুষে সংক্রমিত হতে পারে।

অ্যানথ্রাক্স সাধারণত তিনভাবে ছড়ায়:

•              কাটেনিয়াস (ত্বকের অ্যানথ্রাক্স): কাটা বা ক্ষত দিয়ে জীবাণু প্রবেশ করলে ত্বকে ঘা সৃষ্টি হয়।

•              অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স: অপর্যাপ্ত রান্না করা মাংস খাওয়ার মাধ্যমে ছড়ায়।

•              ইনহেলেশনাল অ্যানথ্রাক্স: সংক্রমিত স্পোর শ্বাসনালী দিয়ে শরীরে প্রবেশ করলে ঘটে।

পীরগাছায় প্রথমে কাটেনিয়াস অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হলেও পরে অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্সের রোগী বাড়তে থাকে। তবে এখনও ইনহেলেশনাল অ্যানথ্রাক্সের রোগী শনাক্ত হয়নি।

নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রভাব

তদন্তে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের আশেপাশে ওষুধ ব্যবসা চালাচ্ছে ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইমতিয়াজ তানভীর সেতু ও তার বড় ভাই গালিবুর রহমান রতু। স্থানীয়ভাবে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এই দুই ভাই ‘পীরগাছা ডেইরি ফার্ম’ দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের পতনের পর।

এই “পীরগাছা ডেইরি ফার্ম”দখল নিতে রতু ও সেতু ক্ষমতাবান চাঁদাবাজ আমিনুল ইসলাম রাঙ্গার সহযোগীতা নেয়। এই সুযোগে রাঙ্গার সাথে রতুর সখ্যতা বাড়ে ও পীরগাছা উপজেলায় বিএনপির নির্বাচনে রতু ও সেতু রাঙ্গার পক্ষে সক্রিয় ভুমিকা রাখে ও আস্থা অর্জন করে। এসময় তারা ক্ষমতাবান আমিনুল ইসলাম রাঙ্গার সহায়তায় প্রভাব বিস্তার করে। রাঙ্গার ঘনিষ্ঠতায় ভেটেরিনারি সার্জনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সেতু-রতু চক্র সরকারি বরাদ্দ, ঋণ, ওষুধ ও ভ্যাকসিন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

স্থানীয় সূত্রে সেতু-রতু চক্রের বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে—

•              খামারিদের নামে সরকারি ঋণ নিয়ে ৬০% কমিশন কেটে নেয়া।

•              সরকারি বরাদ্দকৃত মেশিনারিজ নিজেদের দোকান থেকে চড়া দামে বিক্রি।

•              বেকার দূরীকরণ প্রকল্পে ভুয়া নাম ব্যবহার করে টাকা আত্মসাৎ।

•              বিনামূল্যের সরকারি ওষুধ দোকান থেকে বিক্রি।

•              নেপিয়ার ঘাসের মাঠ দখল করে বিক্রি।

•              সরকারি অনুদানের টাকা ভুয়া তালিকা দিয়ে আত্মসাৎ।

•              লাম্পি রোগের সরকারি টিকা কালোবাজারে কয়েকগুণ দামে বিক্রি।

ভুয়া টিকার সরবরাহ চেইন

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলায় বটতলা মোরের রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী শাহানুর ইসলাম মিলনের কাছ থেকে কম দামে নিম্নমানের লাম্পি রোগের টিকা সংগ্রহ করে রতু-সেতু। এই শাহানুর ইসলাম মিলনের বাড়ি মুলত বগুড়ায়। মিলন এই এই টিকা ২০ টাকা দরে বগুড়া থেকে কিনে রতু-সেতুর কাছে ৫০ টাকায় বিক্রি করে।
সরকারি নানান সুবিধা পেয়ে রতু ও সেতু বগুড়া থেকে নিম্ন মানের ঔষধ এনে তা ভেটেরিনারি সার্জনের মাধ্যমে প্রেস্ক্রিপশন করে সাধারন জনগনকে কিনতে বাধ্য করে। ভেটেরিনারি সার্জনকে এই টিকা প্রেস্ক্রিপশন লিখতে বাধ্য করে ৫ বছরের চুক্তিতে চাকুরি করা বটলতার আশরাফুল আলম মুকুল।
রতু-সেতু এই টিকা ১২০০–১৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। এর বিক্রি থেকে মাসিক কমিশন পায় আমিনুল ইসলাম রাঙ্গা (৩০%) এবং যুবদল আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম জাহান (১০%)। মুকুল কমিশন নেয় ৫%।

অ্যানথ্রাক্স ছড়ানোর মূল কারণ

আইসিডিডিআরবি কর্তৃক সংগ্রহ করা মানুষের ও পশুর নমুনা এবং সন্দেহভাজন ভ্যাকসিনের পরীক্ষায় প্রমাণ মেলে—বগুড়া থেকে আনা নিম্নমানের ভ্যাকসিনের যত্রতত্র ব্যবহার থেকেই পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়েছে।

উপসংহার

পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব শুধুমাত্র অব্যবস্থাপনা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাববলয় ও ভুয়া ভ্যাকসিন বাণিজ্যের ফলাফল। ভেটেরিনারি সার্জনের নীরবতা, সেতু-রতু চক্রের দৌরাত্ম্য এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এ সংকট আজ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

ট্যাগঃ

পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব: ভেটেরিনারি অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবের নেপথ্যে ‘সেতু-রতু-রাঙ্গা চক্র’

সময়ঃ ০৪:০২:৫১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব: ভেটেরিনারি অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক প্রভাবের নেপথ্যে ‘সেতু-রতু-রাঙ্গা চক্র’

রংপুরের পীরগাছা:

গত মে ২০২৫ থেকে রংপুরের পীরগাছায় ভয়াবহ অ্যানথ্রাক্সের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে, মৃত্যু হয়েছে অন্তত ১০ জনের। আক্রান্ত পশুর সংখ্যা হাজারের বেশি বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। শুরুতে এ বিষয়ে নানা অভিযোগ উঠলেও উপজেলা ভেটেরিনারি সার্জনের পক্ষ থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

সাংবাদিকদের সতর্কতা উপেক্ষা

পীরগাছা উপজেলা সাংবাদিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম একাধিকবার ভেটেরিনারি সার্জনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি তা উপেক্ষা করেন। এমনকি পার্শ্ববর্তী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আক্রান্ত রোগীদের দেখতে যেতেও ভেটেরিনারি সার্জন অনীহা দেখান। পরিস্থিতি অবনতির দিকে গেলে সাংবাদিকরা সংবাদ প্রকাশ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হন।

অ্যানথ্রাক্স কী?

অ্যানথ্রাক্স একটি মারাত্মক সংক্রামক ব্যাধি, যা মূলত গরু, ছাগল, ভেড়া ও ঘোড়ার মতো প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়। ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়ার স্পোর থেকে এ রোগের উৎপত্তি হয়, যা মাটি, প্রাণী বা প্রাণীজ পণ্যের মাধ্যমে মানুষে সংক্রমিত হতে পারে।

অ্যানথ্রাক্স সাধারণত তিনভাবে ছড়ায়:

•              কাটেনিয়াস (ত্বকের অ্যানথ্রাক্স): কাটা বা ক্ষত দিয়ে জীবাণু প্রবেশ করলে ত্বকে ঘা সৃষ্টি হয়।

•              অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্স: অপর্যাপ্ত রান্না করা মাংস খাওয়ার মাধ্যমে ছড়ায়।

•              ইনহেলেশনাল অ্যানথ্রাক্স: সংক্রমিত স্পোর শ্বাসনালী দিয়ে শরীরে প্রবেশ করলে ঘটে।

পীরগাছায় প্রথমে কাটেনিয়াস অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হলেও পরে অন্ত্রের অ্যানথ্রাক্সের রোগী বাড়তে থাকে। তবে এখনও ইনহেলেশনাল অ্যানথ্রাক্সের রোগী শনাক্ত হয়নি।

নেপথ্যে রাজনৈতিক প্রভাব

তদন্তে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের আশেপাশে ওষুধ ব্যবসা চালাচ্ছে ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইমতিয়াজ তানভীর সেতু ও তার বড় ভাই গালিবুর রহমান রতু। স্থানীয়ভাবে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত এই দুই ভাই ‘পীরগাছা ডেইরি ফার্ম’ দখল করে নেয় আওয়ামী লীগের পতনের পর।

এই “পীরগাছা ডেইরি ফার্ম”দখল নিতে রতু ও সেতু ক্ষমতাবান চাঁদাবাজ আমিনুল ইসলাম রাঙ্গার সহযোগীতা নেয়। এই সুযোগে রাঙ্গার সাথে রতুর সখ্যতা বাড়ে ও পীরগাছা উপজেলায় বিএনপির নির্বাচনে রতু ও সেতু রাঙ্গার পক্ষে সক্রিয় ভুমিকা রাখে ও আস্থা অর্জন করে। এসময় তারা ক্ষমতাবান আমিনুল ইসলাম রাঙ্গার সহায়তায় প্রভাব বিস্তার করে। রাঙ্গার ঘনিষ্ঠতায় ভেটেরিনারি সার্জনের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সেতু-রতু চক্র সরকারি বরাদ্দ, ঋণ, ওষুধ ও ভ্যাকসিন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

স্থানীয় সূত্রে সেতু-রতু চক্রের বিরুদ্ধে একাধিক গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে—

•              খামারিদের নামে সরকারি ঋণ নিয়ে ৬০% কমিশন কেটে নেয়া।

•              সরকারি বরাদ্দকৃত মেশিনারিজ নিজেদের দোকান থেকে চড়া দামে বিক্রি।

•              বেকার দূরীকরণ প্রকল্পে ভুয়া নাম ব্যবহার করে টাকা আত্মসাৎ।

•              বিনামূল্যের সরকারি ওষুধ দোকান থেকে বিক্রি।

•              নেপিয়ার ঘাসের মাঠ দখল করে বিক্রি।

•              সরকারি অনুদানের টাকা ভুয়া তালিকা দিয়ে আত্মসাৎ।

•              লাম্পি রোগের সরকারি টিকা কালোবাজারে কয়েকগুণ দামে বিক্রি।

ভুয়া টিকার সরবরাহ চেইন

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলায় বটতলা মোরের রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী শাহানুর ইসলাম মিলনের কাছ থেকে কম দামে নিম্নমানের লাম্পি রোগের টিকা সংগ্রহ করে রতু-সেতু। এই শাহানুর ইসলাম মিলনের বাড়ি মুলত বগুড়ায়। মিলন এই এই টিকা ২০ টাকা দরে বগুড়া থেকে কিনে রতু-সেতুর কাছে ৫০ টাকায় বিক্রি করে।
সরকারি নানান সুবিধা পেয়ে রতু ও সেতু বগুড়া থেকে নিম্ন মানের ঔষধ এনে তা ভেটেরিনারি সার্জনের মাধ্যমে প্রেস্ক্রিপশন করে সাধারন জনগনকে কিনতে বাধ্য করে। ভেটেরিনারি সার্জনকে এই টিকা প্রেস্ক্রিপশন লিখতে বাধ্য করে ৫ বছরের চুক্তিতে চাকুরি করা বটলতার আশরাফুল আলম মুকুল।
রতু-সেতু এই টিকা ১২০০–১৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। এর বিক্রি থেকে মাসিক কমিশন পায় আমিনুল ইসলাম রাঙ্গা (৩০%) এবং যুবদল আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর আলম জাহান (১০%)। মুকুল কমিশন নেয় ৫%।

অ্যানথ্রাক্স ছড়ানোর মূল কারণ

আইসিডিডিআরবি কর্তৃক সংগ্রহ করা মানুষের ও পশুর নমুনা এবং সন্দেহভাজন ভ্যাকসিনের পরীক্ষায় প্রমাণ মেলে—বগুড়া থেকে আনা নিম্নমানের ভ্যাকসিনের যত্রতত্র ব্যবহার থেকেই পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্স ছড়িয়ে পড়েছে।

উপসংহার

পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব শুধুমাত্র অব্যবস্থাপনা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রভাববলয় ও ভুয়া ভ্যাকসিন বাণিজ্যের ফলাফল। ভেটেরিনারি সার্জনের নীরবতা, সেতু-রতু চক্রের দৌরাত্ম্য এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এ সংকট আজ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।