০১:২৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ২৪ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

প্রিয় দশ

  • Sangbad365 Admin
  • সময়ঃ ১২:০০:৫৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫
  • ১৬০১৯ Time View

পাতার প্রলাপ

পৌর গোরস্থানে মৃত শেয়ালের পাশে
ব্যাপ্ত চরাচর নিয়ে বসে আছি; একা।
উদ্বুদ্ধ সকাল নম্র রোদের সোনালি দেহ
        আমার পায়ের কাছে মেলে দিলে
সূর্যকে ভাবতে শিখি আলোর দালাল।
দূরে পুষ্পকঙ্কাল, মলিন ধুলা শরীরে মেখে
ললিত সৌরভ-স্মৃতি ভুলে যেতে থাকে।
হয়ত প্রেমিক তার আনত প্রেমের
ভূলুণ্ঠিত প্রতিদান মাটির সান্নিধ্যে ফেলে গেছে।
কত ভুল, পাপের নিয়তি, তীব্র তর্কের করাত
কবরের মাটির ভদ্রতা বুকে নিয়ে
একদিন নত হয়; বিচ্ছিন্ন বনের কাছে
পাখির সম্পর্ক খোঁজে। বস্তুত সম্পর্ক এক জটিল পুরাণ।
মানুষ গল্পের ক্রীড়নক হয়ে ব্যর্থতার করাল সত্যকে
একদিন নিজের সংকটে বুঝে ফেলে;
দেখে, কেউ তার সঙ্গে নেই।
দেহের পুরোনো ছাল ফেলে
        যেভাবে পালায় সাপ, সেরকম
অধীর নিস্তার চেয়ে সবাই পালায়।
স্মৃতিবিষ বুকে নিয়ে
আগুনে আগুনে পুড়ি আমরা সবাই একা একা।

মানুষের শ্রমে আজ উৎকীর্ণ সকাল।
মায়াবী গোরুর চোখে পৃথিবীর সব মধু বোবা হয়ে আছে।
আমূল সাধনাগুলো চুপচাপ হয়;
কত মর্ম-আলাপন গভীর সংকেতে
নিজের জীবনে জমা রাখে
নিঃসঙ্গ বধির।
একটা বিড়াল হাঁটে; তার ভয় চতুর পুলকসহ
           পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে দেখি।
জীবনের লাস্য ঘিরে বহুদিন
মাতাল বাসনা ছিল আমারও; ভেবেছি
লোমশ আদর পেলে
একটা বিড়াল হব নারীর মুঠোয়।
চুপি চুপি টিকে র’বে জান্তব যৌনতা
দুর্বিনীত আমাদের সকল খেলায়।
আজ আমি সঙ্গপ্রিয়; জনতার নিষ্ফল মস্তকে
চমকের মতো মিশে আছি।
পলে পলে সাজানো সকল সংক্রমণে
গ্রীষ্মের মুগ্ধতা দেখি; আর দেখি গোপন শূন্যতাগুলো
ঘুমন্ত খরগোশের পরাজয়ে জেগেছে হঠাৎ।
কারো কারো জীবন তো বিজয়ী কচ্ছপ।

বিষণ্ন মর্মরে ঝিরিঝিরি হাওয়া-গান
আমার শরীর ছুঁয়ে গেলে
         কেন যে পাতার কথা মনে পড়ে আজ!
পাতা এক নিবিড় সবুজ হাহাকার।
বিভোর বাতাসে নড়ে; তবু
চকিতে পাখির মতো উড়তে পারে না।
ডালে ডালে তার শোক, হলুদ বেদনাগুলো
গাছের স্পন্দনে টিকে থাকে;
মড়কে মড়কে শেষ হয়। আহা পাতা!
নিঝুম মৃত্যুর দিকে আমাকেও সঙ্গে নিও।
সবুজ প্রলেপ নিয়ে ঝরে যেতে
               আমি এক পাতা হতে চাই।

নীরবতা কবরের স্পর্ধা।
উদগ্র পোকার চলাফেরা, নীল মাছি
হরিৎ গুল্মের নিচে
সামান্য মলিন ছায়া—সবকিছু মহাকাল;
তুমুল স্খলন যেন; আরেক ভঙ্গুর কোলাহলে
          পরম শান্তির দিকে নষ্ট হতে চায়।
ভাষা হয়ে ফোটে।
প্রজাপতি রঙিন ডানায় লিখে নিজের পতন।
তবু পাতা, তোমার তরঙ্গ আছে স্পর্ধিত মৃত্যুর।
নির্ঝর বেদনা আছে; বিরল মমতা এক বোঁটায় বোঁটায়।
আমি হাতে নিই; আহা! রিনি রিনি তোমার শরীর
স্পন্দিত বুকের মধ্যে তিলে তিলে গড়ে তুলে আমার সাহস।
স্ত্রী-পুত্র, বিবিধ সঙ্গ, আরো দূর ফলনবেষ্টিত স্বজনের
মুখর সত্যকে মানি; তবু
সুকণ্ঠী বন্ধুর গান, প্রেমিকা পসার
আকুল স্তনের দিকে ধাবমান সকল সুখের মেদ, আর
নম্র চুম্বনের আশা দুলতে দুলতে
ঠোঁটের ওপর
যদি কোনোদিন ক্লান্তি বয়ে আনে
আমি খুব একা হতে পারি।
কখনো চন্দনকাঠ অগ্নিদগ্ধ হলে
মানুষ পোড়ার আগে বিগলিত হই।
                  কাঁদি একা একা।

ঘরভর্তি গান

পালক পতন মানে। ক্ষরণ সত্তার
নিবেদিত ডানা, ঝরবেই।
আজ স্পর্শক্ষয়, দূরে মনুষ্য প্রান্তরে
মুছে গেছে সবুজ প্রীতির কোলাকুলি।
চরাচরে হাঁচির শব্দের ভূত-ভয়।
তবু নভোবন
মেঘের নিঃশ্বাসে
পৃথিবীতে নাম লিখে স্মরণ-বৃষ্টির।
মুখ মনে পড়ে। ভেজা ভেজা মুখ।
নিজের হাতের সঙ্গে
নিজের বৈরিতা, অবিশ্বাস।
যেন গুপ্তঘাত এক বিষের প্রলেপ
মাখিয়ে রেখেছি নিজে নিজে।
আমার আত্মার নিরাময়ঘন
ওইসব মুখের উদ্যানে জলগন্ধে
ধুয়ে যেতে থাকি। ভাবি,
আমি এক আদিম উদ্ভিদ। গুল্মলতা পরিচয়। 
লতিয়ে উঠতে চাই গহনে গহনে চিরকাল।

ধূম্র্রল কুহক থেকে দূরে
মির্জা মান্নানের বাড়ি। বাড়ির উঠানে
সঙ্গরত পাখির ভুবন। কমলার
নরম পাতায় সূর্য দরদ ঢালছে।
যতদূর চোখ যায় ফসলের সবুজ স্বরাজ
দিগন্তের গীতল পশ্চিমে
উবু হয়ে আছে। যেন নামাজ পড়ছে।
দূর থেকে দেখা যায় গাছের তাওয়াফ।
মাঝে ওর ঘর। ঘরভর্তি গান।
যে গান লুকিয়ে রাখে পাখি
নিঝুম নীড়ের বুকে
একাকার সুরের পাতায়।

মানুষ মূলত গাছ; শূন্য বেয়ে ওঠে।
মৃত্যুবীজ পুঁতে রাখে জন্মের সময়।
মন হলো ডালপালা;
আকাশ অবধি
    যার আঁকুপাঁকু।
বড়জোর মেঘ দেখে;
বৃষ্টির নিকুঞ্জে মুখ ধোয়।
দূরের গ্রহের বুকে মাথা রেখে
ঘুমাতে পারে না।
পায়ের শেকড় এসে মানুষ জড়ায়।
ওইখানে সুখ;
হৃদয় প্রস্তুত হাতে হাতে।
আজ মির্জা মান্নান হাঁসের মাংস খেতে
ডাক দেয়। হৃদয়ের বাড়া ভাতে
ভালোবাসা ফেরাতে পারি না।
জাগ্রত আত্মার দিকে
লুফে নিই সকল দাওয়াত।
ওর বউ পরিবেশনার
অন্তঃস্থ বিদ্যায় গান ঢালে;
গানের শরীরে
পাখির প্রহর আমি খাই।

ভালোবাসা নিজেই খাদক।
তার পেটে হজম হয়েছি বারবার।

শস্যমালা

বাজারের নাম শস্যমালা
সুতিয়া নদীর পাশে অতনু দেহের মতো সাবলীল মানুষের ভিড়
তামাগলা সূর্যের সিথানে তবু অরণ্যশোভন এই নীরবতা খান খান ভেঙে যাবে আজ
সরব উত্থানে কোন উজ্জীবন
জড়িয়ে রয়েছে এই প্রাণের পেখম জনতার?
তেমাথায় গোল হয়ে সুতিয়া নদীর পাশে অভিলাষহীন?
পণ্যের জঠরে বসে কেউ বুঝি জাদুর দোলক শুধু দু’হাতে নাড়েন
চিলতে রোদের মতো প্রতিপাদ্য সোনার হৃদয় এখানে দারুণ বেচাকেনা হয়।
মনের ব্যঞ্জনে খুব শিখর ছুঁয়েছি বলে মানুষের
আজ বাঁশি হয়ে যাই; উড়ে আসি রঙিন ফানুস আমি হাওয়ায় হাওয়ায় পলাতক।
উলম্ব গতির দিকে মুখ করে প্রতিভায় জেগে আছে গগন শিরীষ
একটি সজনে গাছ, পাতা নাই, ডালে ডালে নিরীহ বিকেল
মনে হয় ভৌতিক কঙ্কাল, শুধু নিরন্ন আঙুলগুলো থাবা মেলে আছে।
পাঁচটি সতীর্থ পাখি এই মাত্র সহসা দুর্বার উড়ে গেল
জীবনের ভাঁজে ভাঁজে পরিবৃত স্বাধীনতা কোথায় লুকিয়ে থাকে এতটা সুলভ?
শুকনো নদীর বুকে ফসলের ঢেউ…
প্রতিবর্ণ সভ্যতার সবুজ আগুন বুঝি জল কেড়ে নিল!
সুবর্ণ কৃষক ছাড়া লোল অভিশাপ তবে কে বুঝে এমন?
বনেদি বাড়ির দিকে ওইযে মেয়েরা তাই গগনবিদারী সুখ, তবু
নিরুপায় একটি বেদনা শুধু আঁচলে বেঁধেছে।
আর বুড়ো বৃক্ষের কোটরে থাকা কুণ্ডলীত সাপের মতন
অনন্য খোঁপায় তারা গুঁজে নিচ্ছে ফুল, সাদা জবা।
মোড়ল বাঁশের মতো আমার যৌবন কেন স্ফীত হয়ে যায়?
নিজেকে খরচ করে সজল ঋণের ভারে নুয়ে পড়ি।
আকাশ এখানে রোজ সহস্র মেঘের কুঁড়েঘর
হিমের কুন্তলে আজ জেগে আছে রমণী সুলভ।
আহা নারী! আমাকে ছোবল দাও, 
সভ্যতা বিলীন করে অরণ্যবাসরে সমধিক নীলকণ্ঠ হয়ে উঠি।

নৈশকালীন

রাতের নৈঃশব্দ্যে
ব্যাঙ ডাকে
টিনের চালে ঝিরি ঝিরি বর্ষার সিগন্যাল
আকাশ ভাঙলে পরে
প্রথম যৌবন-ভাঙা সঙ্গমের মতো
            সাঁতরাব,
            গুমোট মেঘের মতো শুয়ে আছো কেন?
পেলব সমুদ্র হও।
শরীর মন্থনে জল পড়ে;
         পাতা, তুমি কেন নড়বে না আজ?

দৃষ্টিপাত

স্তন
দু’মুঠো জানালা তোমার
উঁকি দিলে অন্তঃপুরে লেলিহান
       পরীর পৃথিবী যেন মানবী শরীর
কতদূর লতাপাতা?
     বনের পশম?
     নাভির প্রদেশে ছত্রখান
         স্পর্শের গণ্ডগ্রাম?
                    নির্জন?
চাঁদ, নিভে যাও
সিঁদেল চোরের কাছে জোছনাকে
শত্রু মনে হয়।

ফুল ফোটে ঝরে যায়

মেয়েদের স্কুলের সামনে
সঙ্ঘমানা ছেলেদের ভিড়
উপযাজকের মতো বড় রাস্তাটায়
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোজ ওরা দেখে
রোদপোড়া সকালের গায়ে
জোটবদ্ধ মেয়েরা আসছে।
ফুলের মালার মতো গ্রন্থনায় জড়িয়ে থাকার
                     সময় পেয়েছে ওরা।
তবু ঘণ্টা পড়ে।
ত্রস্ত বালিকারা ক্লাসে যায়। হাতে বই।
প্রাণে প্রাণে দুহারা নদীর মতো আত্মহারা জল।
কলমে অজস্র চিঠি কালিতে বিলীন হয়ে আছে।
ছুটির ঘণ্টার মতো আনন্দ ধারায়
কখন ভাসাবে ছেলেদের, তা-ই ভাবে।
পড়াশোনা
হৃদয়ে অপাঠ্য রঙ বুঝেনি কখনো।
গন্ধ নাই, তবু সুরভির কথা বলে।
ছেলেরা বাস্তব; যত গন্ধ দিলে ফুল বলে বিশ্বাস করবে
মেয়েরা, ততটা ফুটে থাকে রোজ অমূল্য রাস্তায়।
একদিন ঝরে যাবে।

সত্যবাক

একদিন পালিয়ে যাবার শুভ শুশ্রূষা আমাকে দিয়েছিল
নারীর প্রথম প্রণোদনা
      আর তার সশ্রম প্রমোদ মৌন দেহ বরাবর।
কারাভোগ শেষ করে যে আসামী ঘরে ফেরে
তার মতো বিহ্বল সূর্যকে বুকে নিয়ে
বুঝেছি, যৌবন বড়ো বেপরোয়া।
নিজের দেহের কাছে পরাজিত না হলে প্রেমিক
ঘনিষ্ঠ আঙুল ধরে নারীও কি পায় বলো আমূল সাহস?

(অ)খণ্ড চিত্র

গরম চায়ের কাপে বিমূর্ত বিকেল ধসে পড়ে।
সোভিয়েত ভাঙনের মতো মন
লাল নীল স্বপ্নের বর্ণিল পাটাতনে কুপোকাত—
           ছিনালের মতো ভাসমান যাযাবর।
সাম্যের মৌতাত উবে গেছে কবে!
কেউ বুঝি ক্লোরোফিল ঢেলে
ভুলিয়েছে অভিন্ন দুঃখের দিনভর জ্বালা
হুঁশ ফিরে দেখি
আজকের প্রদোষের কালি
ঘিরে আছে কাপালিক বুকে-ধরা সুরম্য স্বপ্নের চারুপাঠ…

লাল মশালের ধনাঢ্য সময় যারা ধেয়ে এনেছিল
তাদের পায়ের নিচে পুঁজির পুলক।
কাকের গানের পাশে মানুষের বাঁচার ব্যঞ্জনা
কোলাহল ছাড়া কিছু নয়;
লোলুপ ঘাতক আজ অষ্টাদশী বাজারের বুক
            শেয়ারে শেয়ারে যার উঠা-নামা।
পণ্য-সমতলে নীলকণ্ঠ বিষ খেয়ে
ঘুমিয়ে থাকেন প্রেসিডেন্ট।
শ্রমের মোড়ল সেজে হাত মারে মোল্লা মন্ত্রী আর পুরোহিত।
ঘুমঘোরে আরেক টোকাই— শান্তিচোর
যেন আইল্যান্ড
দরপতনের পরাভব নিয়ে রাস্তায় নির্জন;
কাক তার ভোরের কোকিল—
‘লেনিন’ ‘লেনিন’ বলে ডেকে তুলে।

গৃহ—১

নদী-জল বাষ্প হয় সমুদ্র সংসারে।
যমুনায় প্রেম নাই, সেই উত্তাল নম্রতা
তোমার বাতাস; প্রহারের মতো হাতে নিয়ে
গৃহের অরণ্যে
আমাকে পাগল করে তোলো অথবা সন্ন্যাসী।
কথার কূজনে ডাল ভেঙে ভেঙে
এইভাবে গাছের মৃত্যুর মতো
আমাদের প্রেম।

গৃহ—২

রান্নার উদ্যোগে কিছু মুগ্ধ কড়িকাঠ
মসলার গন্ধ নিয়ে মরে—
সেই হাসিমুখ লোভ করে
তোমাকে বানাই বন।
যত কর্মকাল, বন্য গভীরতা বিভিন্ন সংগ্রামে
সবুজ গুঞ্জন, লাল বৃত্ত করে তুলো।
পতাকার মতো তোমার যৌবন
আমার স্বদেশে ওড়ে।

জলবিদ্রুপ

কোয়েলের ডিমের খোসায় কালো কালো ফুটকির মতো
স্পষ্টতর সন্ধ্যা ছিল।
শিউলির গন্ধভরা ভেজা বাতাস ছিল,
আরও ছিল ভালোবাসার মেরুন দ্রবণ—
অশোকার আলতো হাতে গড়া বিবিধ লাড়ুর
মৃদু আপ্যায়নে।
অশোকার আনাড়ি প্রেমিকও পাশে ছিল কাল।
অর্থহীন কথার তোড়ে ঠোঁট দুটো ভারী ছিল প্রেমিকের।
তবু এক নিগূঢ় মায়ায়
অলৌকিক টান বুঝেছিল অশোকা প্রেমিকের দিকে।
নবীন আগন্তুক আমি স্থবির বিন্দুর মতো বিছানায় ছিলাম বসে।
হঠাৎ এক দুর্বোধ্য শয়তান প্রাচীন কাক হয়ে হৃদয়ে ঠোকর দিল।
প্রতিপক্ষ মরা কাক নিস্তেজ পড়েছিল পাশে?
তবে কি আমিও প্ররোচিত হয়েছিলাম কাবিলের মতো আদিম ঈর্ষায়?
বোনের লোভে জ্বলে উঠেছিলাম পৃথিবীর প্রথম হন্তারক?

এই লোভ, এই ঈর্ষাও প্রচ্ছন্ন ভালোবাসা ছিল কাল সন্ধ্যায়,
দারুণ কৌতূহলে আগুনের পিণ্ড মুখে নেওয়া শিশু মুসার মতো অবুঝ।
কিংবা এ ছিল হৃদয়ের শূন্যতায় শুধুই নিমগ্ন হতাশা আমার।
তবু অ্যান্টার্কটিকার আচ্ছন্ন বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায়
অশোকা যখন বলল, দাদা, আপনি আসাতে খুব খুশি হয়েছি।
ব্যাঙের পেচ্ছাপ খেয়ে মুহূর্তেই নিভে গেল অন্তরের বৈরী আগুন।

কাজী নাসির মামুনের জন্ম ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩। শৈশব থেকে বসবাস ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। নব্বই দশকের শুরুর দিকে নাটকের পাশাপাশি গল্প লেখা, পরবর্তী সময়ে কবিতা মনোনিবেশ করেন। সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘মেইনরোড’। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ কাক তার ভোরের কোকিল (২০১৭), রোহিঙ্গাপুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই (২০১৮), মুহূর্তগুলো তরবারি (২০২২) এবং রাষ্ট্রনৈতিক সনেটগুচ্ছ (২০২৫)। পেয়েছেন বিতাসংক্রান্তি সম্মাননা (২০০৭), লোক লেখক সম্মাননা (২০২০)। 

ট্যাগঃ

প্রিয় দশ

সময়ঃ ১২:০০:৫৪ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৩ অক্টোবর ২০২৫

পাতার প্রলাপ

পৌর গোরস্থানে মৃত শেয়ালের পাশে
ব্যাপ্ত চরাচর নিয়ে বসে আছি; একা।
উদ্বুদ্ধ সকাল নম্র রোদের সোনালি দেহ
        আমার পায়ের কাছে মেলে দিলে
সূর্যকে ভাবতে শিখি আলোর দালাল।
দূরে পুষ্পকঙ্কাল, মলিন ধুলা শরীরে মেখে
ললিত সৌরভ-স্মৃতি ভুলে যেতে থাকে।
হয়ত প্রেমিক তার আনত প্রেমের
ভূলুণ্ঠিত প্রতিদান মাটির সান্নিধ্যে ফেলে গেছে।
কত ভুল, পাপের নিয়তি, তীব্র তর্কের করাত
কবরের মাটির ভদ্রতা বুকে নিয়ে
একদিন নত হয়; বিচ্ছিন্ন বনের কাছে
পাখির সম্পর্ক খোঁজে। বস্তুত সম্পর্ক এক জটিল পুরাণ।
মানুষ গল্পের ক্রীড়নক হয়ে ব্যর্থতার করাল সত্যকে
একদিন নিজের সংকটে বুঝে ফেলে;
দেখে, কেউ তার সঙ্গে নেই।
দেহের পুরোনো ছাল ফেলে
        যেভাবে পালায় সাপ, সেরকম
অধীর নিস্তার চেয়ে সবাই পালায়।
স্মৃতিবিষ বুকে নিয়ে
আগুনে আগুনে পুড়ি আমরা সবাই একা একা।

মানুষের শ্রমে আজ উৎকীর্ণ সকাল।
মায়াবী গোরুর চোখে পৃথিবীর সব মধু বোবা হয়ে আছে।
আমূল সাধনাগুলো চুপচাপ হয়;
কত মর্ম-আলাপন গভীর সংকেতে
নিজের জীবনে জমা রাখে
নিঃসঙ্গ বধির।
একটা বিড়াল হাঁটে; তার ভয় চতুর পুলকসহ
           পায়ে পায়ে এগিয়ে আসতে দেখি।
জীবনের লাস্য ঘিরে বহুদিন
মাতাল বাসনা ছিল আমারও; ভেবেছি
লোমশ আদর পেলে
একটা বিড়াল হব নারীর মুঠোয়।
চুপি চুপি টিকে র’বে জান্তব যৌনতা
দুর্বিনীত আমাদের সকল খেলায়।
আজ আমি সঙ্গপ্রিয়; জনতার নিষ্ফল মস্তকে
চমকের মতো মিশে আছি।
পলে পলে সাজানো সকল সংক্রমণে
গ্রীষ্মের মুগ্ধতা দেখি; আর দেখি গোপন শূন্যতাগুলো
ঘুমন্ত খরগোশের পরাজয়ে জেগেছে হঠাৎ।
কারো কারো জীবন তো বিজয়ী কচ্ছপ।

বিষণ্ন মর্মরে ঝিরিঝিরি হাওয়া-গান
আমার শরীর ছুঁয়ে গেলে
         কেন যে পাতার কথা মনে পড়ে আজ!
পাতা এক নিবিড় সবুজ হাহাকার।
বিভোর বাতাসে নড়ে; তবু
চকিতে পাখির মতো উড়তে পারে না।
ডালে ডালে তার শোক, হলুদ বেদনাগুলো
গাছের স্পন্দনে টিকে থাকে;
মড়কে মড়কে শেষ হয়। আহা পাতা!
নিঝুম মৃত্যুর দিকে আমাকেও সঙ্গে নিও।
সবুজ প্রলেপ নিয়ে ঝরে যেতে
               আমি এক পাতা হতে চাই।

নীরবতা কবরের স্পর্ধা।
উদগ্র পোকার চলাফেরা, নীল মাছি
হরিৎ গুল্মের নিচে
সামান্য মলিন ছায়া—সবকিছু মহাকাল;
তুমুল স্খলন যেন; আরেক ভঙ্গুর কোলাহলে
          পরম শান্তির দিকে নষ্ট হতে চায়।
ভাষা হয়ে ফোটে।
প্রজাপতি রঙিন ডানায় লিখে নিজের পতন।
তবু পাতা, তোমার তরঙ্গ আছে স্পর্ধিত মৃত্যুর।
নির্ঝর বেদনা আছে; বিরল মমতা এক বোঁটায় বোঁটায়।
আমি হাতে নিই; আহা! রিনি রিনি তোমার শরীর
স্পন্দিত বুকের মধ্যে তিলে তিলে গড়ে তুলে আমার সাহস।
স্ত্রী-পুত্র, বিবিধ সঙ্গ, আরো দূর ফলনবেষ্টিত স্বজনের
মুখর সত্যকে মানি; তবু
সুকণ্ঠী বন্ধুর গান, প্রেমিকা পসার
আকুল স্তনের দিকে ধাবমান সকল সুখের মেদ, আর
নম্র চুম্বনের আশা দুলতে দুলতে
ঠোঁটের ওপর
যদি কোনোদিন ক্লান্তি বয়ে আনে
আমি খুব একা হতে পারি।
কখনো চন্দনকাঠ অগ্নিদগ্ধ হলে
মানুষ পোড়ার আগে বিগলিত হই।
                  কাঁদি একা একা।

ঘরভর্তি গান

পালক পতন মানে। ক্ষরণ সত্তার
নিবেদিত ডানা, ঝরবেই।
আজ স্পর্শক্ষয়, দূরে মনুষ্য প্রান্তরে
মুছে গেছে সবুজ প্রীতির কোলাকুলি।
চরাচরে হাঁচির শব্দের ভূত-ভয়।
তবু নভোবন
মেঘের নিঃশ্বাসে
পৃথিবীতে নাম লিখে স্মরণ-বৃষ্টির।
মুখ মনে পড়ে। ভেজা ভেজা মুখ।
নিজের হাতের সঙ্গে
নিজের বৈরিতা, অবিশ্বাস।
যেন গুপ্তঘাত এক বিষের প্রলেপ
মাখিয়ে রেখেছি নিজে নিজে।
আমার আত্মার নিরাময়ঘন
ওইসব মুখের উদ্যানে জলগন্ধে
ধুয়ে যেতে থাকি। ভাবি,
আমি এক আদিম উদ্ভিদ। গুল্মলতা পরিচয়। 
লতিয়ে উঠতে চাই গহনে গহনে চিরকাল।

ধূম্র্রল কুহক থেকে দূরে
মির্জা মান্নানের বাড়ি। বাড়ির উঠানে
সঙ্গরত পাখির ভুবন। কমলার
নরম পাতায় সূর্য দরদ ঢালছে।
যতদূর চোখ যায় ফসলের সবুজ স্বরাজ
দিগন্তের গীতল পশ্চিমে
উবু হয়ে আছে। যেন নামাজ পড়ছে।
দূর থেকে দেখা যায় গাছের তাওয়াফ।
মাঝে ওর ঘর। ঘরভর্তি গান।
যে গান লুকিয়ে রাখে পাখি
নিঝুম নীড়ের বুকে
একাকার সুরের পাতায়।

মানুষ মূলত গাছ; শূন্য বেয়ে ওঠে।
মৃত্যুবীজ পুঁতে রাখে জন্মের সময়।
মন হলো ডালপালা;
আকাশ অবধি
    যার আঁকুপাঁকু।
বড়জোর মেঘ দেখে;
বৃষ্টির নিকুঞ্জে মুখ ধোয়।
দূরের গ্রহের বুকে মাথা রেখে
ঘুমাতে পারে না।
পায়ের শেকড় এসে মানুষ জড়ায়।
ওইখানে সুখ;
হৃদয় প্রস্তুত হাতে হাতে।
আজ মির্জা মান্নান হাঁসের মাংস খেতে
ডাক দেয়। হৃদয়ের বাড়া ভাতে
ভালোবাসা ফেরাতে পারি না।
জাগ্রত আত্মার দিকে
লুফে নিই সকল দাওয়াত।
ওর বউ পরিবেশনার
অন্তঃস্থ বিদ্যায় গান ঢালে;
গানের শরীরে
পাখির প্রহর আমি খাই।

ভালোবাসা নিজেই খাদক।
তার পেটে হজম হয়েছি বারবার।

শস্যমালা

বাজারের নাম শস্যমালা
সুতিয়া নদীর পাশে অতনু দেহের মতো সাবলীল মানুষের ভিড়
তামাগলা সূর্যের সিথানে তবু অরণ্যশোভন এই নীরবতা খান খান ভেঙে যাবে আজ
সরব উত্থানে কোন উজ্জীবন
জড়িয়ে রয়েছে এই প্রাণের পেখম জনতার?
তেমাথায় গোল হয়ে সুতিয়া নদীর পাশে অভিলাষহীন?
পণ্যের জঠরে বসে কেউ বুঝি জাদুর দোলক শুধু দু’হাতে নাড়েন
চিলতে রোদের মতো প্রতিপাদ্য সোনার হৃদয় এখানে দারুণ বেচাকেনা হয়।
মনের ব্যঞ্জনে খুব শিখর ছুঁয়েছি বলে মানুষের
আজ বাঁশি হয়ে যাই; উড়ে আসি রঙিন ফানুস আমি হাওয়ায় হাওয়ায় পলাতক।
উলম্ব গতির দিকে মুখ করে প্রতিভায় জেগে আছে গগন শিরীষ
একটি সজনে গাছ, পাতা নাই, ডালে ডালে নিরীহ বিকেল
মনে হয় ভৌতিক কঙ্কাল, শুধু নিরন্ন আঙুলগুলো থাবা মেলে আছে।
পাঁচটি সতীর্থ পাখি এই মাত্র সহসা দুর্বার উড়ে গেল
জীবনের ভাঁজে ভাঁজে পরিবৃত স্বাধীনতা কোথায় লুকিয়ে থাকে এতটা সুলভ?
শুকনো নদীর বুকে ফসলের ঢেউ…
প্রতিবর্ণ সভ্যতার সবুজ আগুন বুঝি জল কেড়ে নিল!
সুবর্ণ কৃষক ছাড়া লোল অভিশাপ তবে কে বুঝে এমন?
বনেদি বাড়ির দিকে ওইযে মেয়েরা তাই গগনবিদারী সুখ, তবু
নিরুপায় একটি বেদনা শুধু আঁচলে বেঁধেছে।
আর বুড়ো বৃক্ষের কোটরে থাকা কুণ্ডলীত সাপের মতন
অনন্য খোঁপায় তারা গুঁজে নিচ্ছে ফুল, সাদা জবা।
মোড়ল বাঁশের মতো আমার যৌবন কেন স্ফীত হয়ে যায়?
নিজেকে খরচ করে সজল ঋণের ভারে নুয়ে পড়ি।
আকাশ এখানে রোজ সহস্র মেঘের কুঁড়েঘর
হিমের কুন্তলে আজ জেগে আছে রমণী সুলভ।
আহা নারী! আমাকে ছোবল দাও, 
সভ্যতা বিলীন করে অরণ্যবাসরে সমধিক নীলকণ্ঠ হয়ে উঠি।

নৈশকালীন

রাতের নৈঃশব্দ্যে
ব্যাঙ ডাকে
টিনের চালে ঝিরি ঝিরি বর্ষার সিগন্যাল
আকাশ ভাঙলে পরে
প্রথম যৌবন-ভাঙা সঙ্গমের মতো
            সাঁতরাব,
            গুমোট মেঘের মতো শুয়ে আছো কেন?
পেলব সমুদ্র হও।
শরীর মন্থনে জল পড়ে;
         পাতা, তুমি কেন নড়বে না আজ?

দৃষ্টিপাত

স্তন
দু’মুঠো জানালা তোমার
উঁকি দিলে অন্তঃপুরে লেলিহান
       পরীর পৃথিবী যেন মানবী শরীর
কতদূর লতাপাতা?
     বনের পশম?
     নাভির প্রদেশে ছত্রখান
         স্পর্শের গণ্ডগ্রাম?
                    নির্জন?
চাঁদ, নিভে যাও
সিঁদেল চোরের কাছে জোছনাকে
শত্রু মনে হয়।

ফুল ফোটে ঝরে যায়

মেয়েদের স্কুলের সামনে
সঙ্ঘমানা ছেলেদের ভিড়
উপযাজকের মতো বড় রাস্তাটায়
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোজ ওরা দেখে
রোদপোড়া সকালের গায়ে
জোটবদ্ধ মেয়েরা আসছে।
ফুলের মালার মতো গ্রন্থনায় জড়িয়ে থাকার
                     সময় পেয়েছে ওরা।
তবু ঘণ্টা পড়ে।
ত্রস্ত বালিকারা ক্লাসে যায়। হাতে বই।
প্রাণে প্রাণে দুহারা নদীর মতো আত্মহারা জল।
কলমে অজস্র চিঠি কালিতে বিলীন হয়ে আছে।
ছুটির ঘণ্টার মতো আনন্দ ধারায়
কখন ভাসাবে ছেলেদের, তা-ই ভাবে।
পড়াশোনা
হৃদয়ে অপাঠ্য রঙ বুঝেনি কখনো।
গন্ধ নাই, তবু সুরভির কথা বলে।
ছেলেরা বাস্তব; যত গন্ধ দিলে ফুল বলে বিশ্বাস করবে
মেয়েরা, ততটা ফুটে থাকে রোজ অমূল্য রাস্তায়।
একদিন ঝরে যাবে।

সত্যবাক

একদিন পালিয়ে যাবার শুভ শুশ্রূষা আমাকে দিয়েছিল
নারীর প্রথম প্রণোদনা
      আর তার সশ্রম প্রমোদ মৌন দেহ বরাবর।
কারাভোগ শেষ করে যে আসামী ঘরে ফেরে
তার মতো বিহ্বল সূর্যকে বুকে নিয়ে
বুঝেছি, যৌবন বড়ো বেপরোয়া।
নিজের দেহের কাছে পরাজিত না হলে প্রেমিক
ঘনিষ্ঠ আঙুল ধরে নারীও কি পায় বলো আমূল সাহস?

(অ)খণ্ড চিত্র

গরম চায়ের কাপে বিমূর্ত বিকেল ধসে পড়ে।
সোভিয়েত ভাঙনের মতো মন
লাল নীল স্বপ্নের বর্ণিল পাটাতনে কুপোকাত—
           ছিনালের মতো ভাসমান যাযাবর।
সাম্যের মৌতাত উবে গেছে কবে!
কেউ বুঝি ক্লোরোফিল ঢেলে
ভুলিয়েছে অভিন্ন দুঃখের দিনভর জ্বালা
হুঁশ ফিরে দেখি
আজকের প্রদোষের কালি
ঘিরে আছে কাপালিক বুকে-ধরা সুরম্য স্বপ্নের চারুপাঠ…

লাল মশালের ধনাঢ্য সময় যারা ধেয়ে এনেছিল
তাদের পায়ের নিচে পুঁজির পুলক।
কাকের গানের পাশে মানুষের বাঁচার ব্যঞ্জনা
কোলাহল ছাড়া কিছু নয়;
লোলুপ ঘাতক আজ অষ্টাদশী বাজারের বুক
            শেয়ারে শেয়ারে যার উঠা-নামা।
পণ্য-সমতলে নীলকণ্ঠ বিষ খেয়ে
ঘুমিয়ে থাকেন প্রেসিডেন্ট।
শ্রমের মোড়ল সেজে হাত মারে মোল্লা মন্ত্রী আর পুরোহিত।
ঘুমঘোরে আরেক টোকাই— শান্তিচোর
যেন আইল্যান্ড
দরপতনের পরাভব নিয়ে রাস্তায় নির্জন;
কাক তার ভোরের কোকিল—
‘লেনিন’ ‘লেনিন’ বলে ডেকে তুলে।

গৃহ—১

নদী-জল বাষ্প হয় সমুদ্র সংসারে।
যমুনায় প্রেম নাই, সেই উত্তাল নম্রতা
তোমার বাতাস; প্রহারের মতো হাতে নিয়ে
গৃহের অরণ্যে
আমাকে পাগল করে তোলো অথবা সন্ন্যাসী।
কথার কূজনে ডাল ভেঙে ভেঙে
এইভাবে গাছের মৃত্যুর মতো
আমাদের প্রেম।

গৃহ—২

রান্নার উদ্যোগে কিছু মুগ্ধ কড়িকাঠ
মসলার গন্ধ নিয়ে মরে—
সেই হাসিমুখ লোভ করে
তোমাকে বানাই বন।
যত কর্মকাল, বন্য গভীরতা বিভিন্ন সংগ্রামে
সবুজ গুঞ্জন, লাল বৃত্ত করে তুলো।
পতাকার মতো তোমার যৌবন
আমার স্বদেশে ওড়ে।

জলবিদ্রুপ

কোয়েলের ডিমের খোসায় কালো কালো ফুটকির মতো
স্পষ্টতর সন্ধ্যা ছিল।
শিউলির গন্ধভরা ভেজা বাতাস ছিল,
আরও ছিল ভালোবাসার মেরুন দ্রবণ—
অশোকার আলতো হাতে গড়া বিবিধ লাড়ুর
মৃদু আপ্যায়নে।
অশোকার আনাড়ি প্রেমিকও পাশে ছিল কাল।
অর্থহীন কথার তোড়ে ঠোঁট দুটো ভারী ছিল প্রেমিকের।
তবু এক নিগূঢ় মায়ায়
অলৌকিক টান বুঝেছিল অশোকা প্রেমিকের দিকে।
নবীন আগন্তুক আমি স্থবির বিন্দুর মতো বিছানায় ছিলাম বসে।
হঠাৎ এক দুর্বোধ্য শয়তান প্রাচীন কাক হয়ে হৃদয়ে ঠোকর দিল।
প্রতিপক্ষ মরা কাক নিস্তেজ পড়েছিল পাশে?
তবে কি আমিও প্ররোচিত হয়েছিলাম কাবিলের মতো আদিম ঈর্ষায়?
বোনের লোভে জ্বলে উঠেছিলাম পৃথিবীর প্রথম হন্তারক?

এই লোভ, এই ঈর্ষাও প্রচ্ছন্ন ভালোবাসা ছিল কাল সন্ধ্যায়,
দারুণ কৌতূহলে আগুনের পিণ্ড মুখে নেওয়া শিশু মুসার মতো অবুঝ।
কিংবা এ ছিল হৃদয়ের শূন্যতায় শুধুই নিমগ্ন হতাশা আমার।
তবু অ্যান্টার্কটিকার আচ্ছন্ন বরফের মতো ঠাণ্ডা গলায়
অশোকা যখন বলল, দাদা, আপনি আসাতে খুব খুশি হয়েছি।
ব্যাঙের পেচ্ছাপ খেয়ে মুহূর্তেই নিভে গেল অন্তরের বৈরী আগুন।

কাজী নাসির মামুনের জন্ম ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩। শৈশব থেকে বসবাস ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। নব্বই দশকের শুরুর দিকে নাটকের পাশাপাশি গল্প লেখা, পরবর্তী সময়ে কবিতা মনোনিবেশ করেন। সম্পাদিত ছোটকাগজ ‘মেইনরোড’। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থঃ কাক তার ভোরের কোকিল (২০১৭), রোহিঙ্গাপুস্তকে আত্মহত্যা লেখা নেই (২০১৮), মুহূর্তগুলো তরবারি (২০২২) এবং রাষ্ট্রনৈতিক সনেটগুচ্ছ (২০২৫)। পেয়েছেন বিতাসংক্রান্তি সম্মাননা (২০০৭), লোক লেখক সম্মাননা (২০২০)।